
u
একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা (তাওহীদ)
আমাদের প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়, “আপনাদের সমস্যাটা কী, আপনারা সবসময় তাওহীদ নিয়ে কথা বলেন এবং এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন? এটা না করে আপনারা বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের অবস্থার দিকে কেন নজর দেন না? আপনারা কি দেখতে পান না বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছে? আলোচনা করার মতো এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি আর নেই?”
এর জবাবে আমরা বলি: প্রথমত, তাওহীদ (আল্লাহর এককত্ব) হলো ইবাদতে আল্লাহকে একক হিসেবে সাব্যস্ত করা। এটা ইসলামের মূল ভিত্তি। তাই তাওহীদকে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ হলো ইসলামের ভিত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া। যখন লোকেরা তাওহীদ এবং এর প্রকৃত অর্থকে উপেক্ষা করে এবং এর অর্থের বিরোধিতা করে, তখন তাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। আমরা যদি কুরআন ও তাতে বর্ণিত হেদায়েতের আলোকে চিন্তা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই তা তাওহীদকে এতটাই বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে যে – কুরআনে এমন কোনো সূরাহ পাওয়া যাবে না যা তাওহীদের বিষয়ে কিছু না কিছু উল্লেখ করেনা, এবং তাওহীদ বিরোধী বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেনা। এই কারণে সমগ্র কুরআন জুড়ে আমরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাই অথবা আমরা আল্লাহর কর্ম ও রুবূবিয়্যাহ সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাই যা প্রমাণ করে, তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা ও সমস্ত সৃষ্টিকুলের নিয়ন্ত্রক। এর মধ্যে আমরা আল্লাহর ঐ নির্দেশকে খুঁজে পাই যে শুধু তাঁরই ইবাদত করতে হবে এবং (ইবাদতে) তাঁর সমস্ত শরীককে বর্জন করতে হবে। এর মধ্যে আমরা ঐ সমস্ত আয়াত খুঁজে পাই যা ইবাদতে আল্লাহর সাথে শরীক করার ভয়াবহ পরিণাম থেকে সতর্ক করে, এবং তিনি ব্যতীত অন্য সকল কিছুকে উপাসনা করার নিষেধাজ্ঞাকে সম্পূর্ণরূপে সাব্যস্ত করে- কেননা এটা সমস্ত পাপের মধ্যে সবচাইতে বড় পাপ।
উপরন্তু, আমরা দেখতে পাই যে আল্লাহ, তাঁর এবং তাঁর রাসূল, মুহাম্মাদ (ﷺ) এর আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন কেননা তা তাওহীদের হক। আল্লাহ তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকারীদের জন্য পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন- তারা চিরন্তন জান্নাতের উদ্যানে থাকবে এবং যারা তাওহীদকে প্রত্যাখ্যান করে ও তাঁর ইবাদতে তাঁর সাথে শরীক করে তাদের জন্য তিনি শাস্তি ও আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন- তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। তাই সমগ্র কুরআন তাওহীদের এই মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। আমরা যদি রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) এর জীবনের দিকে তাকাই তাহলে নিশ্চিতরূপে দেখতে পাই যে, তিনি তাঁর নবুওয়াতের তেরটি বছর মক্কায় ও দশ বছর মদীনায় অতিবাহিত করেছেন। যেই সময়ে তিনি মক্কায় অবস্থানরত ছিলেন, তিনি মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা থেকে সতর্ক করেছেন। ঐ সময়ে না যাকাত, না রোজা, না হজ্জ, না হিজাব, না শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি, না বাদবাকি ওয়াজিব বা নিষেধাজ্ঞা আর না সামাজিকতা সম্পর্কিত কোনো ওয়াহী নাযিল করা হয়েছিল- বরং ঐ সবই মদীনায় হিজরতের পর প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো সালাত (নামায) যা রাসূল (ﷺ) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের কিছু সময় পূর্বে ফরয করা হয়েছিল। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও তাগুতের উপাসনা পরিত্যাগ করার এই আহ্বানের প্রতি যে চরম গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা যে কেউ খুব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। আর ইসলামে এর সুমহান মর্যাদার কারণেই তাওহীদের বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই একবার যখন এই তাওহীদ মুমিনদের অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেল তখন মহান আল্লাহ যাকাত, রোজা, হজ এবং ইসলামিক পরিচ্ছদসহ বাকি ফরয আমলগুলো নাযিল করলেন। আর এর কারণ হলো বাহ্যিক ইবাদতের কোনটিই যদি তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে মহান আল্লাহ তা কবুল করেন না। মানবজাতিকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করার এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলদের প্রেরণ করেছেন এবং তারা প্রত্যেকেই তাওহীদ দিয়ে তাদের দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেছেন। যেভাবে আল্লাহ বলেছেন:
“আর আমরা প্রত্যেক জাতির প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।” (কুরআন, আন-নাহল: ৩৬)
এবং
“আমি তোমার পূর্বে যে রাসূলই পাঠিয়েছি, (হে মুহাম্মাদ ﷺ), তার প্রতি আমি এই ওয়াহী করেছি যে, আমি ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই। কাজেই তোমরা আমারই ‘ইবাদাত করো।” (কুরআন, আল-আম্বিয়া: ২৫)
এবং প্রত্যেক নবী তাঁর ক্বাওমকে বলতেন:
“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনও ইলাহ নেই, আমি তোমাদের প্রতি এক গুরুতর দিনের শাস্তির আশঙ্কা করছি।” (কুরআন, আল-আ‘রাফ: ৫৯)
আর যারা নবীদের পথকে অনুসরণ করেন তাদের সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে যে – তারাও তাওহীদের বিষয়টিকে তার প্রাপ্য গুরুত্বটুকু দিয়ে থাকেন এবং তারা এর মাধ্যমে তাদের দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন। সত্যিকার অর্থে আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে নিহিত, যেমনটি তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন:
“আমি জিন এবং মানবজাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (কুরআন, আয-যারিয়াত: ৫৬)
সুতরাং কেউ যদি তার রবের ইবাদত না করে, বা তাঁর সাথে অন্য কারও ইবাদত করে, তাহলে সে তাওহীদকে লঙ্ঘন করেছে এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় পাপ করেছে। অনেক মুসলিম এবং কাফেরদের মাঝে বিরাট ভুল ধারণা রয়েছে- তারা মনে করে যে তাওহীদ বলতে শুধুমাত্র আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে (পালনকর্তৃত্বে) বিশ্বাস করাকে এবং এর স্বীকৃতি দেয়াকে বুঝায়, অর্থাৎ তিনিই স্রষ্টা, পালনকর্তা, জীবন ও মৃত্যুদাতা এবং তিনি হলেন মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক এবং তারা দাবি করে যে, কেউ যদি শুধু এতটুকু বিশ্বাস করে এবং এর স্বীকৃতি দেয়, তাহলে সে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং সে একজন ইমানদার মুসলিম বটে। তাওহীদ (আল্লাহর এককত্ব) শুধুমাত্র আল্লাহর কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এই ভুল ধারণাটি কিছু মুসলিম সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে প্রচার করছে। তারা এটা স্বীকার করে না যে, আদম, নূহ, ইব্রাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) এর মতো তাঁর প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে যেই তাওহীদকে তিনি (মহান আল্লাহ) চেয়েছিলেন তা ছিল সমস্ত ইবাদতে একমাত্র আল্লাহকে একক সাব্যস্ত করার তাওহীদ (তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ)। এমনকি নবী (ﷺ) এর যুগের মূর্তিপূজারীরাও এটা নিশ্চিত বিশ্বাস করত যে আল্লাহই হলেন স্রষ্টা, পালনকর্তা, জীবন ও মৃত্যুর মালিক, কিন্তু এরপরও তারা তাঁকে ছাড়া অন্যের উপাসনা করেছে। তাই একক রব ও স্রষ্টার (তাওহীদুর রুবূবিয়্যার) উপর নিছক বিশ্বাস ও তার স্বীকৃতি প্রদান তাদের কোনও উপকারে আসেনি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
“(হে নবী, কাফেরদের বলুন) কে তোমাদেরকে আসমান ও জমীন থেকে রিযিক দেন? কে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির মালিক এবং কে মৃতকে জীবিত করেন এবং কে জীবিতকে মৃতে পরিণত করেন এবং কে সকল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন? তারা বলবে, “আল্লাহ।” অতঃপর তাদেরকে বলুন, “তোমরা কি তাহলে ভয় করবে না?” (কুরআন, ইঊনুস: ৩১)
সুতরাং রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সাথে মূর্তি ও কবর পূজারীদের মধ্যকার বিরোধ তাদের এই অস্বীকৃতির কারণে হয়নি যে আল্লাহ একমাত্র রব ও স্রষ্টা, বরং তা এই কারণে হয়েছিল যে, তাদের ইবাদতকে তারা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বা তাদের ইবাদতকে তারা আল্লাহ এবং তাদের মূর্তি ও কবরবাসীদের মাঝে বণ্টন করতে চেয়েছিল। এই বিষয়টিকে অনেক সমসাময়িক মুসলিম সম্প্রদায় উপেক্ষা করেছে। বর্তমান সময়ে কিছু সংখ্যক মুসলিম এই মিথ্যা দাবি করে যে, যারা মৃতদেরকে তাদের কবরে ডাকে এবং তাদের কাছে উদ্ধার কামনা করে তারা শিরক করছে না কারণ তারা তো এই বিশ্বাস করে না যে, ঐ মৃতরা তাদের সৃষ্টি করেছে বা তারা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে – এবং যতক্ষণ না তারা এটা বিশ্বাস করছে, তারা তাদের ঐ কাজকে শিরক বলে মনে করে না। তারা দাবি করে যে, তারা আল্লাহর সাথে যে সমস্ত কিছুকে ডাকে, তা সে নবী, ওলী, পীর, ফেরেশতা ইত্যাদি যেই হোক না কেন, তারা হলো তাদের ও আল্লাহর মাঝে মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারী মাত্র। তাদের লেখা (বই-প্রবন্ধ) ও বক্তৃতাগুলোতে তারা দাবি করে: “আমরা শুধু ওলী এবং নবীদেরকে ডাকি কারণ তারা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারী মাত্র”- আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর যুগের মূর্তিপূজারীদেরও এই একই দাবি ছিল। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে মুশরিকরা তাদের মূর্তি সম্পর্কে বলত:
“আমরা শুধু এই জন্য তাদের ইবাদত করি যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।” (কুরআন আয-যুমার: ৩)
এবং মহান আল্লাহ মুশরিকদের সম্পর্কে বলেছেন:
“তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদত করে, যারা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না এবং তারা বলে, তারা হলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।” (কুরআন, ইঊনুস: ১৮)
বর্তমান সময়ে আমরা মুসলিমদেরকে সব থেকে বড় পাপে নিমজ্জিত হতে দেখতে পাই এবং তারা বলে, “কবরবাসীদের ডাকা এবং মৃতদের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া শিরক নয়, বরং এটা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম এবং আমরা কেবল তাদের কাছে সুপারিশ চাই, কারণ তারা আল্লাহর প্রিয়জন। তাই তারা মধ্যস্থতাকারী ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এটা শিরক নয়, কেননা শিরক হলো এটা বিশ্বাস করা যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য একজন স্রষ্টা বা পালনকর্তা আছেন।” আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের এই বক্তব্যটি পূর্বযুগীয় মুশরিকদের বক্তব্য যা আমরা উপরোক্ত কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণ করেছি। আরেকটি সন্দেহ যা আমরা মাঝে মধ্যে শুনতে পাই তা হলো, “আমরা তো কেবল মৃতদের ডাকি ও তাদের কাছে সাহায্য চাই, তার মানে এই নয় যে আমরা তাদের উপাসনা করছি।” তাদের এই বক্তব্যটি নিশ্চিতরূপে অকাট্য দলীল-প্রমাণের পরিপন্থী। কেননা আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:
“আর মাসজিদসমূহ একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।” (কুরআন, আল-জিন: ১৮)
এবং তিনি বলেছেন:
“আর যে আল্লাহর সাথে অন্য কোনও উপাস্যকে ডাকে এর পক্ষে তার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। আর তার হিসাব হবে তার রবের নিকটে। নিঃসন্দেহে কাফেররা কখনো সফলকাম হবে না।” (কুরআন, আল-মু’মিনূন: ১১৭)
তাই আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে যে আমরা যেন সকল ইবাদতকে শুধুমাত্র আল্লাহর (تبرك وتعالى) জন্য উৎসর্গ করি কেননা তিনিই স্রষ্টা, পালনকর্তা, জীবন ও মৃত্যুর মালিক এবং তিনিই রিযিক প্রদানকারী। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের সেই রবের ইবাদত করো, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো। যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিশ্রামের স্থান বানিয়েছেন এবং আকাশকে বানিয়েছেন ছাউনি এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দিয়ে তোমাদের জন্য জমি থেকে শস্য ও ফল-ফসল উদগত করেছেন। সুতরাং তোমরা ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক কোরো না, যদিও তোমরা এ সবকিছু জানো।” (কুরআন, আল-বাক্বারাহ: ২১-২২)
এই আয়াতটি কুরআনের খুব প্রথমেই আবির্ভূত হয়েছে এবং এতে মানবজাতির প্রতি প্রথম সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। এবং এই আদেশটি সমগ্র মানবজাতিকে তাদের একক রব ও স্রষ্টার সাথে কাউকে শরীক না করে শুধু তাঁর ইবাদত করার প্রতি নির্দেশ করে। এই আয়াতে আল্লাহর কিছু কর্মের উল্লেখ করা হয়েছে- এবং এই কর্মগুলোই রুবূবিয়্যাতে তাঁর এককত্বকে গঠন করে এবং আমাদের রবের এই কর্মগুলোই প্রতিষ্ঠিত করে যে কেন আমাদের কোনো অংশীদার বা সহযোগী ছাড়াই তাঁর ইবাদত করতে হবে। তাই আমরা শুধু তাঁরই উপাসনা করি এবং শুধু তাঁর কাছে সাহায্য, উদ্ধার ও আশ্রয় প্রার্থনা করি- আমরা কেবল তাঁকেই ডাকি, যেহেতু অন্য যেসব ইলাহদেরকে ডাকা হয় তারা আমাদের সৃষ্টি করেনি, তারা আমাদের পালন করে না, বৃষ্টি বর্ষণ করে না বা ফসল উদগত করে না। তাহলে কেন আমরা নবীকে সাহায্য বা সুপারিশের জন্য ডাকব, যখন আমরা সরাসরি তার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে পারি? তাহলে আমরা কেন কবরের সৎকর্মশীল বাসিন্দাদের, ফেরেশতাদের বা জিনদেরকে ডাকব যখন আমরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে পারি? নিশ্চয়ই আল্লাহ কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন তাঁকে ছাড়া আর অন্য কাউকে না ডাকি:
“তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। নিশ্চয়ই যারা অহংকার বশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্চিত হয়ে।” (কুরআন, আল-গাফির: ৬০)
আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন:
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সুতরাং তোমরা সূর্য ও চন্দ্রকে সেজদা কোরো না, বরং আল্লাহকে সেজদা করো যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তুমি সত্যিকার অর্থে তাঁরই ইবাদত করো।” (কুরআন, আল-ফুসসিলাত: ৩৭)
এই আয়াতটি স্পষ্ট করে যে, সমস্ত বাহ্যিক ইবাদত যেমন সেজদা করা এবং রুকু করা শুধুমাত্র আল্লাহর অধিকার এবং তা কোনো ভাবেই সূর্য, চন্দ্র, ফেরেশতা, নবী, কবর বা পূর্বপুরুষদের প্রতি নিবেদন করা যাবে না। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন:
“আমার কবরকে মসজিদের স্থান হিসেবে গ্রহণ কোরো না।” (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলামে ইবাদত সেই সমস্ত কথা ও কাজকে অন্তর্ভুক্ত করে যা তিনি (আল্লাহ্) পছন্দ করেন এবং যার উপর তিনি সন্তুষ্ট, হোক তা অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক। যে মুসলিম দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন, তিনি তার সালাতের প্রতিটি রাকাতে বলেন:
“আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য চাই।” (কুরআন, আল-ফাতিহাহ: ৫)
এবং নবী নিজেই বলেছেন:
“দুআ হলো ইবাদত।” (আবূ দাঊদ তার সুনানে বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরতা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, তাই ইসলাম তাবীজ, যাদুমন্ত্র, কুসংস্কার এবং অশুভ লক্ষণের উপর নির্ভর করতে নিষেধ করে কারণ এই সমস্ত বিষয়গুলো আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা ও বিশ্বাস স্থাপন করাকে বিনষ্ট করে। মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, এবং
“আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনও বিপদ আসে না, এবং যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত।” (কুরআন, আত-তাগাবুন: ১১)
নবী (ﷺ) বলেন:
“যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো সে শিরক করল”। (মুসনাদে আহমাদ এ বর্ণিত)
আর এটার প্রমাণ হলো, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবী হুযায়ফাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এক ব্যক্তিকে দেখলেন সে জ্বর থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তার বাহুর চারপাশে একটি দড়ি পরেছে, তখন তিনি তা খুলে ফেললেন ও তা কেটে ফেললেন। (তাফসীরু ইবনি আবী হাতিমে বর্ণিত) সুতরাং আমরা ইতঃপূর্বে যা উল্লেখ করেছি, তা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যেই অধিকারগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট তা কোনো ভাবে লঙ্ঘন করা আমাদের জন্য জায়েয নয় – উদাহরণস্বরূপ, অদৃশ্য এবং ভবিষ্যতের জ্ঞান দাবি করা কারও জন্য জায়েজ নয় কেননা অদৃশ্যের জ্ঞানী একমাত্র আল্লাহ, তাই কোনো গ্রহাচার্য, গণক বা জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া বৈধ নয়। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি কোনো জ্যোতিষীর সাথে দেখা করে এবং সে যা বলে তাতে বিশ্বাস করে সে মুহাম্মাদের উপর নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি অবিশ্বাস করেছে।” (আবূ দাঊদে বর্ণিত)
এবং তা আল্লাহর নিম্নোক্ত বক্তব্যের কারণে যে:
“তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) কাছে অদৃশ্যের চাবিকাঠি রয়েছে এবং একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কেউ অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না।” (কুরআন, আল-আন‘আম: ৫৯)
এবং
“নিশ্চয়ই, কেয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করান এবং মাতৃগর্ভে যা আছে তা তিনি জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন ভূখন্ডে সে মারা যাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা, সর্বজ্ঞ।” (কুরআন, আল-লুক্বমান: ৩৪)
উপসংহার:
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন কেন সালাফীরা (অর্থাৎ আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামাআহ) তাওহীদের বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্ব দেন এবং কেন তারা তাওহীদের প্রাপ্য অগ্রাধিকারটুকু দিয়ে থাকেন। তাওহীদ (আল্লাহর এককত্ব) হলো সমস্ত ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবেদিত করা এবং তিনি ব্যতীত যে সকল কিছুর ইবাদত করা হয় ঐ সমস্ত কিছুর ইবাদতকে বর্জন করা।
লিখেছেন আবূ খাদীজাহ ‘আব্দুল-ওয়াহিদ।