
u
কিভাবে ইসলাম নারী জাতিকে বিমুক্ত করেছে
নারী অধিকার কর্মী ও লেখিকা, অ্যানি বেসান্ট বলেছেন: “যিনি আরবের সুমহান নবীর জীবন ও তাঁর চরিত্রকে অধ্যয়ন করেছেন এবং যিনি জানেন তিনি কীভাবে শিক্ষা দিয়েছেন ও তিনি কীভাবে জীবন যাপন করেছেন, তবে সেই মহান নবীর প্রতি তাকে শ্রদ্ধাশীল হতেই হবে, যিনি ছিলেন মহিমান্বিতের সুমহান রসূলগণের একজন।” [The Life And Teachings of Muhammad, 1932, p.4]
ইসলাম ও নারী
ইসলামে নারীদের অবস্থানকে ঘিরে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে, তবে বেশিরভাগ আলোচনা এমন ব্যক্তিবর্গের দ্বারা হয়েছে যারা এই দ্বীন সম্পর্কে খুব কম জানেন। ১৪০০ বছর পূর্বে ইসলাম নারী জাতিকে বিমুক্ত করেছে। সাফ্রাজেটস ও নারী অধিকার আন্দোলন কার্যকর হওয়ার বহু আগে থেকে উত্তরাধিকারপ্রাপ্তি, সম্পত্তির মালিকানা, শিক্ষা ও স্বামী বেছে নেওয়ার মতো মানবাধিকারকে নারীদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশ্চাত্যে সবচাইতে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হলো ইসলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতদের মধ্যে ৮০% নারী এবং যুক্তরাজ্যে ধর্মান্তরিতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী (The Times newspaper, 9th November 1993)। সুতরাং, আপনি যদি ইসলামে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে তেমন কিছু না জেনে থাকেন, তাহলে আপনি নিজেকে একটি প্রশ্ন করতে পারেন : “কেন ‘স্বাধীনচেতা পশ্চিমা’ নারীরা অনেকেই মুসলিম হতে চান?” এই লিফলেটটি সংক্ষেপে তার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করবে।
নারীদের প্রতি প্রাক্তন কিছু অবিচার
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে, আদম (আলাইহিস সালাম)-এর পতনের মূল হিসেবে ইভকে দায়ী করা হয়েছে ও তাঁকে ‘original sin’ এর প্রবর্তনকারিনী ও একজন দুষ্ট প্রলোভনকারিনী হিসেবে দেখানো হয়েছে (Genesis ২:৪-৩:২৪)। বাইবেলে বলা হয়েছে : “কোনো নষ্টামি নারীর নষ্টামির ধারে কাছেও আসে না। পাপের উৎপত্তি একজন নারীকে দিয়ে এবং তাকে ধন্যবাদ (তার কারণে) আমাদের সবাইকে মরতে হবে।” (Ecclesiastes ২৫:১৯,২৪)। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেই নির্যাতন নারীদের সাথে হয়ে আসছে, তার বেশিরভাগই এই মিথ্যার উপর নির্মিত যে, নারীরা জন্মগতভাবে নিকৃষ্ট। ১৯ শতকের শেষ দিকের English Common Law বলে, একজন নারীর সকল সম্পত্তি তার স্বামীর। ১৮৮৭ সালে নারীরা আইনতভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অনুমতি পান। অবশেষে, ১৯৬৪ সালে ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের সমঅধিকার প্রদান করে। ১৪০০ বছর পূর্বে মুসলিম নারীদের যেই মর্যাদা ও অধিকার ইসলাম নিশ্চিত করেছে তার সাথে এটির তুলনা করুন।
আধ্যাত্মিক/ধর্মীয় দিক
সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে, পুরুষ ও নারীর মাঝে ইসলাম একেবারেই কোনো পার্থক্য করে না; এমনকি ভালো কাজের বিনিময়ে বিরাট পুরস্কার ও পাপের বিনিময়ে উপযুক্ত শাস্তির প্রতিশ্রুতি উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১৪০০ বছর পূর্বে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কর্তৃক যেই কুরআন নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর নাযিল করা হয়েছে তাতেই বলা হয়েছে : “অবশ্যই আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) নারী, মু’মিন পুরুষ ও মু’মিনা নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগতা নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীতা নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী, সিয়াম পালনকারী পুরুষ ও সিয়াম পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযাতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযাতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী – এদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান।” [কুরআন ৩৩:৩৫]
সামাজিক দিক
ইসলামের আবির্ভাবকালে, অধিকাংশ সমাজে নারীদের প্রতি নির্মম আচরণ করা হতো ও পুরুষদের পক্ষপাতিত্ব করা হতো এবং তা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলো। এমনকি পরিবারের প্রথম জন্ম নেওয়া শিশু যদি মেয়ে হতো, তবে তা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বিধায় প্রায়শই তাদের হত্যা করা হতো! এমনকি বর্তমান যুগে, বহু সংস্কৃতি মেয়ে শিশুদের প্রতি ভ্রুকঞ্চিত করে, এমনকি শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে জরায়ুর সন্তানকে গর্ভপাত করে ফেলা হয়। কিন্তু ইসলাম এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দেয় ও পিতামাতাকে সক্রিয়ভাবে তাদের কন্যা সন্তানদের প্রতি সদাচরণে উৎসাহিত করে, এমনকি স্বয়ং আল্লাহ এটিকে পিতামাতার জন্য জান্নাতে প্রবেশের একটি মাধ্যম বানিয়েছেন । নারীদের প্রতি সদাচরণ দ্বীন ইসলামের একটি অংশ। নবী মুহাম্মাদ ﷺ শিখিয়েছেন, “মুমিনদের মাঝে ইমানের দিক থেকে সবচাইতে নিখুঁত হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে উত্তম আখলাকের অধিকারী। আর তোমাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম হলো সেই ব্যক্তি যে তার (অধীনে থাকা) নারীদের কাছে উত্তম।” নবী মুহাম্মাদ ﷺ -এর নিজেরও কন্যা সন্তান ছিলো, তন্মধ্যে ছিলেন ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা), যার সম্পর্কে তিনি বলতেন, “আমার ফাতিমাকে যা কষ্ট দেয় তা আমাকেও কষ্ট দেয়।” তিনি ﷺ আরও বলেছেন, “চারজন নারীকে আল্লাহ পূর্ণতা দিয়েছেন : ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর মা মারইয়াম (আলাইহাস সালাম), ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া (আলাইহাস সালাম), খুওয়াইলিদ কন্যা খাদীজাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ও মুহাম্মাদ কন্যা ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)।” ইসলাম যে নারীদের কতটা মূল্যায়ন করে উপরোক্ত বাণীগুলো তা প্রমাণ করে।
শিক্ষার গুরুত্ব
ইসলাম চায় পিতামাতাগণ তাদের মেয়েদের সুশিক্ষিত করে তুলুক। রাসূল ﷺ বলেছেনঃ “ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয।” সুতরাং ইলম অর্জন করা ও সুশিক্ষিত হওয়ার আদেশ উভয় লিঙ্গের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। অথচ আজ বহু সমাজ, নারীদেরকে শিক্ষিত করে তোলাকে লজ্জাজনক বলে মনে করে, এমনকি কিছু অজ্ঞ মুসলিম আছেন যারা নারীদের সুশিক্ষিত হয়ে উঠাকে আঁড় চোখে দেখেন। এটা ভুল, কারণ তা কুরআনের অকাট্য দলীল ও নবীর সুন্নাহ’র বিরোধী। কেননা নবী ﷺ এর নিজ স্ত্রী আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ইসলামী জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর ছাত্র ‘উরওয়াহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘কুরআনের তাফসীর, ফরয-ওয়াজিব, হারাম-হালাল, কবিতা, সাহিত্য, আরবের ইতিহাস ও বংশতালিকায় আমি আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর চেয়ে বড় কোনো আলিমা দেখিনি।” আরেকজন মহিলা সাহাবী সাফিয়্যাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সম্পর্কে বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ ইমাম আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: “তিনি ছিলেন বিদ্বান নারীদের মাঝে সবচাইতে বুদ্ধিমতী।” নবীর স্ত্রী উম্মু সালামাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর অধীনে অন্তত বত্রিশজন প্রখ্যাত আলিম ছিলেন যারা তাঁর থেকে হাদীস শিখেছিলেন। প্রখ্যাত আলিম মারওয়ান বলতেন : “আমরা কেন অন্যের দিকে (ইলমের জন্য) ফিরে যাবো যখন রাসূলের স্ত্রীরা আমাদের মাঝে বিদ্যমান?” ইসলামে বিদ্বান নারীদের অফুরন্ত একটি তালিকা রয়েছে; যা প্রমাণ করে, নারীদেরকে নিরক্ষর কিংবা অজ্ঞ রাখা হয়নি বরং, সুশিক্ষা ও তাতে পাণ্ডিত্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে যাতে তারা তাদের সন্তানদের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে উঠতে পারেন। এমনও উদাহরণ আছে যেখানে নারী-অধিকার পরিপন্থী কিছু বলার কারণে নারীরা তাদের সমসাময়িক আলিমদের চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেছেন। মুসলিম নারীরা শুধু জ্ঞান অর্জন করেই ক্ষান্ত হন না বরং তাকে উচ্চ নৈতিক গুণাবলীর সাথে একত্রিত করেন যা ইসলাম মানবজাতির ভবিষ্যত মায়েদের মধ্যে লালন করতে চায়।
কল্পকাহিনী থেকে সত্যকে পৃথক করা
চৌদ্দশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ইসলামে নারী অধিকার সম্পর্কে এখানে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা হলো:
১. প্রাক-ইসলামিক প্রথা; যেমন নারীদের অবমাননা, নিপীড়ন, ও মেয়েদের সাথে দুর্ব্যবহারকে ইসলাম নিন্দা জানিয়েছে।
২. ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা ও তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীন মালিকানার অধিকারকে নিশ্চিত করেছে যা পিতা, স্বামী, ভাই, পুত্র থেকে স্বতন্ত্র।
৩. নারীরা চাপমুক্ত হয়ে বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। এই অধিকার ইসলাম তাদেরকে দিয়েছে। জোরপূর্বক বিয়ে কোনো ভাবেই দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত না।
৪. ইসলাম কোনো নারীকে তার বিবাহের পর তার নামের উপাধি পরিবর্তন করতে বা তার সম্পদ ত্যাগ করতে বলে না।
৫. ইসলাম পরিবারকে রক্ষা করে ও ব্যভিচার দ্বারা বৈবাহিক বিশ্বস্ততার যে প্রতারণা করা হয় তার নিন্দা জানায়।
৬. ইসলাম চিন্তা-চেতনা, আচার-ব্যবহার ও বাহ্যিক অবয়বে নৈতিকতা বজায়ের নির্দেশ দেয়। এমন পোশাক ও সামাজিক আচার-আচরণ যা নারীকে ভোগের বস্তুতে পরিণত করে তা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা একজন নারীকে প্রাথমিকভাবে তার দ্বীনদারী ও তার চারিত্রিক উৎকর্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
৭. সতীত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার দায়িত্বকে পুরুষ ও নারী উভয়ের কাছ থেকে ইসলাম সমানভাবে দাবি করে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “নারী হলো পুরুষের যমজ।”
৮. ইসলামে মায়েদের সুউচ্চ অধিকার রয়েছে। তাদের প্রতি অবশ্যই দয়াশীল হতে হবে, তাদের স্নেহ করতে হবে ও তাদের সেবা-যত্ন করতে হবে।
বিবাহ এবং তালাক
ইসলাম বিয়েকে শুধুমাত্র মানুষের বংশবৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে দেখে না বরং তা মানসিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক সম্প্রীতির একটি উৎস হিসেবেও দেখে। কুরআন নারী ও পুরুষের এই অপরিহার্য মিলনকে একটি সুন্দর উপমা দ্বারা বুঝিয়েছে, “তারা তোমাদের পরিচ্ছদ আর তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (কুরআন ২:১৮৭) যেমনিভাবে পোশাক আমাদের নগ্নতাকে আড়াল করে, তেমনিভাবে একজন স্বামী-স্ত্রী, বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে, একে অপরের সতীত্বকে রক্ষা করেন। পোশাক যেমন শরীরকে আরাম দেয়, তেমনিভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে প্রশান্তি দেন এবং তদ্বিপরীত। যেমনিভাবে পোশাক হচ্ছে লাবণ্য, সৌন্দর্য ও দেহের শোভা, স্ত্রীরা তাদের স্বামীর কাছে অনুরূপ আর তাদের স্বামীর কাছে তার স্ত্রীরাও অনুরূপ। ভালোবাসা ও দয়া হচ্ছে বিয়ের ভিত্তি; যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেছেন: “এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।।” (কুরআন ৩০:২১) ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে বিয়ে করার পরিবর্তে ও স্বামী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদেরকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে বিয়ে করার প্রয়োজন তাদের নেই। নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে বিয়ে ইসলামী আইন অনুযায়ী অবৈধ। কিছু মুসলিম যারা পুরোনো রীতিনীতি অনুসরণ করেন, তারা নারীদের এই (বিয়ের) প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করাকে, যার অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে, তার বিরোধিতা করেন, কিন্তু এর জন্য ইসলামকে দায়ী করা যাবে না বরং, দায়ী করতে হবে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে। বৈবাহিক জীবনে নারী একজন পৃথক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত, যেই কারণে বিয়ের পর তার প্রথম নামকে তিনি অক্ষত রাখতে পারেন ও তা পরিবর্তন করার আর প্রয়োজন পড়ে না। তবে পাশ্চাত্যে এর বিপরীতটা ঘটে। এর উৎপত্তি মূলত Greco-Roman সংস্কৃতি থেকে, যেখানে নারীকে নিজের স্বামীর নাম গ্রহণ করতে হতো, কারণ নারীকে পুরুষের সম্পত্তি মনে করা হতো। প্রয়োজনে তালাক দেওয়া ইসলামে অনুমোদিত। তবে ইসলাম উভয় পক্ষের অধিকারকে সম্মান করার আদেশ দেয় ও যাতে সীমা অতিক্রান্ত না হয় তার প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে।
মা
সন্তানদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে পিতামাতাগণ যে ত্যাগ স্বীকার করেন, ইসলাম তার স্বীকৃতি দেয়। ইসলামে মায়ের একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো : “হে আল্লাহর রাসূল, মানুষের মধ্যে আমার সদাচরনের সবচেয়ে বেশি হকদার কে?” নবী ﷺ বললেন, “তোমার মা।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো: “এরপর কে?” তিনি বললেন, “তোমার মা।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো, “এরপর কে?” নবী ﷺ উত্তরে বললেন, “তোমার মা।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো, “এরপর কে?” তখন নবী ﷺ বললেন, “তোমার পিতা।” এটি প্রমাণ করে যে, বাবার চেয়ে মাকে তিনগুণ বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ ইসলামে অন্যতম মহৎ কাজ হিসেবে দেখা হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, “আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না ও পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বোলো না ও তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো
।” (কুরআন ১৭:২৩)
হিজাব: ড্রেস কোড
ইসলামে নারীকে অত্যন্ত মূল্যবান ও সুন্দর হিসেবে দেখা হয় বিধায় তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা হয়। হিজাবকে মুসলিম নারীরা নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতা হিসেবে দেখেন, কেননা সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তখন শুধু আর শারীরিক গঠনের উপর নির্ভর করে না, বরং তখন তা নির্ভর করে তাদের মন, ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিকতার উপর। হিজাব, শোষণের পরিবর্তে সুরক্ষাকে নিশ্চিত করে। পুরুষের দ্বারা নারী ও তার দেহের শোষণ-ই মূলত ধর্ষণ, সহিংসতা ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধ বৃদ্ধির পিছনে অন্যতম কারণ। এটা লক্ষণীয় যে, যখন খ্রিস্টান নানরা মুসলিম নারীদের অনুরূপ পোশাক পরিধান করেন, তখন তাদেরকে ধর্মীয় মত প্রকাশকারী ও স্বাধীনচেতা হিসেবে দেখা হয়, অথচ মুসলিম নারীদের ঠিক একই কারণে নির্যাতিতা হিসেবে দেখা হয়! ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত একজন পুরুষকে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, যাতে তা অন্যান্যদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকে, যা আরও প্রমাণ করে নারী ও তার দেহকে ইসলাম কতটা সম্মান করে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে ইসলাম কতটা গুরুত্বের সাথে দেখে এটা মূলত তার-ই ইঙ্গিত করে।
অর্থনীতি এবং কর্মক্ষেত্র
ইসলাম নারীদের জন্য একটি বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করেছে যা অন্যান্য সংস্কৃতি করেনি, আর তা হলো ব্যক্তি মালিকানা ও উত্তরাধিকার। ইসলামী আইন অনুসারে: অর্থ, রিয়েল এস্টেট বা অন্যান্য সম্পত্তির উপর একজন নারীর অধিকার সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত। নারীদের কর্মসংস্থানে যোগদানের ক্ষেত্রে, এটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইসলাম প্রাথমিকভাবে তার ভূমিকাকে একজন মা ও স্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করে। কেননা একজন মায়ের স্থানকে বাসার কাজের লোক বা পরিচারিকা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। যাইহোক, ইসলাম নারীদেরকে নার্সিং, শিক্ষকতা ও চিকিৎসার মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে চাকরী করতে নিষেধ করে না, যা একটি সমাজের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। ইসলামে একজন পুরুষ তার স্ত্রী, তার সন্তানাদী ও ক্ষেত্রবিশেষে – তার গরীব আত্মীয়স্বজন ও তাদের মধ্যে যারা নারী তাদের ভরণপোষণের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এই দায়িত্বটি তার স্ত্রীর সম্পদে বা তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত আয়ে তার হস্তক্ষেপ থাকার কারণে মওকূফ বা হ্রাস পায় না। পুরুষ ও নারীর মাঝে আর্থিক বোঝার এই তারতম্যটি উত্তরাধিকারি আইনে প্রতিফলিত হয়, তাই নারীরা তুলনামূলক কম সম্পদের উত্তরাধিকারী হন কারণ তাদের আর্থিক দায়ভার কম।
বহুবিবাহ
যখন ইসলাম ও নারীর ব্যাপারে কথা উঠে, লোকেরা প্রায়ই বহুবিবাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। হ্যাঁ, ইসলাম বহুবিবাহের অনুমতি দেয় যদি পুরুষ এবং নারী উভয়েই তাতে স্বেচ্ছায় সম্মতি দেয় এই শর্তে যে স্বামী ন্যায়বিচার করবেন, “তোমার পছন্দের নারীদের বিয়ে করো, দুই বা তিন বা চারটি। কিন্তু যদি তুমি আশঙ্কা করো যে, তুমি তাদের সাথে ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তবে একজনকেই বিয়ে করো।” (কুরআন ৪:৩) সুতরাং, পুরুষের যদি অতিরিক্ত স্ত্রী থাকে, তবে অবশ্যই তাদের প্রতি ন্যায়সংগত আচরণ করতে হবে, এবং প্রতিটি স্ত্রীকে সমানভাবে ভরণপোষণ দিতে হবে। এটি বর্তমান সমাজে যা চলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে বিবাহিত পুরুষেরা ব্যভিচার করে বেড়ান, লুকিয়ে পরকিয়া করেন ও যেখানে অবিচার করা-ই হলো স্বাভাবিক। নারীরা নিয়মিত দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হন, ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের বংশ, রক্ষণাবেক্ষণ বা উত্তরাধিকারের কোনো অধিকার থাকে না। এই ধরনের অন্যায়ের কুফল অনেক সমাজে দেখা যায়। ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা প্রায়শই বহুবিবাহের জন্য ইসলামের সমালোচনা করে, অথচ ওল্ড টেস্টামেন্টের বেশিরভাগ নবীর অসংখ্য স্ত্রী ছিল। এটা স্পষ্ট যে ঈসা (আলাইহিস সালাম) কখনই বহুবিবাহ সংক্রান্ত আইনকে প্রত্যাহার করেননি, যে কারণে তা আজ অবধি চলমান। বহুবিবাহের পক্ষসমর্থনে এটাও বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীতে পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা বেশি, তাই সমস্ত নারী যাতে বিয়ে করতে পারেন, তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এটি একটি ন্যায়সংগত উপায়। একজন বিবাহিত নারীকে তার স্বামী আর্থিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারার কারণে, তিনি নিজেকে একজন অভীষ্ট স্ত্রী ও মা হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। যুক্তরাজ্যের গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৬০% পুরুষ তাদের স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করেছে এবং প্রায় ৫০% বিয়ে তালাকে পরিণত হয়েছে। (independent.co.uk, “Are we meant to be monogamous”, 10 March 2015) নিঃসন্দেহে, আমাদের এই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজকে ইসলাম একটি সুষম ও সৌজন্যসূচক সমাধান প্রদান করে।
উপসংহার
আল্লাহ দ্বীনদার নারী ও দ্বীনদার পুরুষ উভয়কে জান্নাত ও অনন্ত জীবন দিয়ে পুরস্কৃত করবেন, তবে এর অর্থ এই নয় যে, নারী ও পুরুষ উভয় সমান। দুটি লিঙ্গকে এক ও অভিন্ন বলে মনে করা দুর্বলতা ও সুস্পষ্ট একটি ভুল। তারা বিভিন্ন দিক থেকে একে অপরের চেয়ে ভিন্ন: শারীরিকভাবে, শারীরবৃত্তীয় ও মানসিকভাবে। আল্লাহ ও তাঁর নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) যুগে যুগে এই পার্থক্যটি তুলে ধরেছেন ও প্রতিটি লিঙ্গের জন্যে তার নিয়ম, নির্দেশনা ও দায়িত্বভার নিযুক্ত করেছেন। মাসিক, বিয়ে, মোহরানা, সন্তান প্রসব, মাতৃত্ব, স্তন্যপান, পিতৃত্ব, অভিভাবকত্ব, পারিবারিক রক্ষণাবেক্ষণ, লালন-পালন, শিক্ষা, ভরণপোষণ ইত্যাদি সম্পর্কিত সকল বিষয়ে আল্লাহ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কিছু নিয়ম পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট, কিছু নারীর জন্য নির্দিষ্ট ও কিছু সমানভাগে ভাগ করা হয়েছে। এভাবেই সমাজে ভারসাম্য ও সম্প্রীতি বজায় থাকে, যেখানে পরিবারগুলো শক্তিশালী, কর্তব্যপরায়ণ ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত, তারা যত্নশীল ও সমাজের প্রত্যেকের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে নিবেদিতপ্রাণ। এখন সত্য খুঁজে বের করা আপনার দায়িত্ব। এই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা দ্বারা আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে ইসলামে নারীদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয় না। হতে পারে ইসলামকে আপনি যা ভেবেছিলেন সেটা তা নয়। আমরা আপনাকে ইসলামের ব্যাপারে আরও জ্ঞান অর্জন করতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সূত্র: ইসলাম ও নারী, প্রকাশনা: সালাফী পাবলিকেশন্স